অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বর্ধমান জেলায় আরার কারও মতে বাকুড়ায় ভৃগুরাম দাস জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পাটীগণিতের অনেক জটিল নিয়ম শিশুদের জন্য সরল আর্যায় অর্থাৎ এক প্রকার বিশেষ কবিতা রচনা করেন। এই জন্য তিনি “শুভঙ্কর” উপাধী লাভ করেছিলেন। তার কয়েকটি সৃষ্টি উত্তর সহকারে দিয়ে দিলাম।
আসলে একটি জাতির অতীত সম্পর্কে জানা থাকা তাদের ঐতিহ্যেরই অংশ। আমরা যতই টেকনোলজি ও নিজেদের মর্ডান ভাবছি ততোই অতীতের প্রতি উদাসীন হচ্ছি। কিন্তু কেন? বাঙালীরা সেই প্রাচীন আমল থেকে জ্ঞান চর্চায় অন্যতম। কিন্তু আজ অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যাবেই বা না কেনো। আমরা যে অন্য জাতির মতো মূল্যবান কিছু জেনারেশনের পর জেনারেশন লালন করে যেতে পারি না। আমাদের অনেক স্মার্ট স্মার্ট মানুষের (যারা স্বঘোষিত জ্ঞাণী দাবি করে) কছে পুরাতন মানে অবজ্ঞার পাত্র। দেখুন না পুরাতনকে ঘেটে অনেক কিছু পাবেন।
একটা জিনিস খেয়াল করেছেন আগের মানুষ যা মুখে মুখে একেবারে সঠিক হিসেব বেড় করে ফেলতেন। আজ আমরা একই জিনিস ক্যালকুলেটরে ৩বার হিসেব করেও সিওর হতে পারি না বরং পুনরায় আবারও ক্যালকুলেটর দিয়ে হিসেব করে নিশ্চত হই।
১.
ত্রিশ হাত উচ্চ বৃক্ষ
ছিল এক স্থানে।
চুড়ায় উঠিত এক কীট
করে মনে।।
দিবাভাগে দশ হত উঠিতে
লাগিলো।
নিশাযোগে অষ্ট হাত নীচেতে
নামি ল।।
না পায় যাবৎ চুড়া করে সে অটন।
কত দিনে উঠেছিল কর নিরুপণ।।
উত্তর: এখানে এক বুক পুরো দিনে (দিন ও রাত) কীট মোট দু’হাত ওঠে। তার ওঠার শেষ দিকে দিবাভাগে যে শেষ দশ হাত উঠলে চূড়ান্ত ওঠা হবে। বাকি (বিশ) হাত কীট ওঠা-নামা করেছিল বা 10 দিন।
অতএব, মোট সময় লাগবে পুরো 10 দিন + একটি দিবাভাগ = 10 দিন।
২.
সরোবরে বিকশিত কমল নিকর।
মধুলাভে এল তথা অনেক ভ্রমর।।
প্রতি পদ্মে বসে যদি ভ্রমন
যুগল।
অলিহীন রহে, তবে একটি কমল।।
একেক ভ্রমর বসে প্রত্যেক
কমলে।
বাকী রহে এক অলি, সংখ্যা দেহ বলে।।
উত্তর: পদ্ম সংখ্যা X ও ভ্রমর সংখ্যা Y হলে, প্রশ্নানুসারে।
Y=2(X-1)…..(i)
Y=X+1…….(ii)
(i) ও (ii) সমাধান করে, x=3, y=4
সরোবরে 3 ও টি পদ্ম ও 4 টি ভ্রমর এসেছিল।
৩.
জমা হুয়া যেত্তা সেপাই।
হুগলি গিয়া উসকা তেহাই।।
পদনা-পার গিয়া আধ।
দশমা ভাগ জাহানবাদ।।
বাকী রহা এক হাজার।
কেত্তা সেপাই কহ জমাদার।।
উত্তর: সিপাহী সংখ্যা X হলে,
প্রশ্নমতে,
=> 10X + 15X + 3X+1000=30X
=> 2X=30000
=> X=15000
:. মোট সিপাহী সংখ্যা 15000 জন।
৩.
দুই বৃক্ষে দুই পারাবত
বসি।
একটি অন্যের প্রতি কহিছে
সম্ভাষি।।
যদ্যপি একটি আসে তব দল
হতে।
তোদের ত্রিগুন হই তাহার
সহিতে।।
অন্য বলে, যোগে মোরা সম হতে পারি।
এক পক্ষী আসে যদি তব
দল ছাড়ি।।
প্রতি দলে ছিল কত কপোত
বসিয়া।
প্রকৃত উত্তর দেহ হিসাব
করিয়া।।
উত্তর: দুই দলের পারাবত সংখ্যা x ও y হলে,
X+1=3(Y-1)...........(i)
x-y=y+1………………….(ii)
(i)ও (ii) এর সমাধান করে, x=5, y=3
:. দুটি দলের পারাবত সংখ্যা ৫ ও ৩।
৪.
এক গোষ্টি ত্রিপথগামী,
সপ্ত ঘাটে গিয়ে পানি।
দ্বাদশ গোপে গাভী দোয়।
নব কৃক্ষের তলায় শোয়।
(গাভী সংখ্যা= ?)
উত্তর: এখানে গোষ্ঠের গাভী সংখ্যা এমন হবে যা ৩,৭,১২ ও ৯
দ্বারা বিভাজ্য অর্থাৎ নির্ণয়ে সংখ্যা ৩,৭,৯ ও ১২ এর সাধারণ গুনিতক।সুতারাং ৩,৭,৯ ও ১২ এর ল,সা,গু ২৫২ হলো গাভীর সংখ্যা।
৫.
আছিল দেউল এক ইচিত্র
গঠন।
ক্রোধে জলে ফেলে দিল
পঠন নন্দনা।।
অর্ধেক পাঙ্কেতে তার
তেহাই সলিলে।
দশম ভাগের ভাগ শেওলার দলে।।
উপরে দ্বাদশ গজ রহে বিদ্যমান।
কর শিশু দেউলের উচ্চতা
প্রমাণ।।
(তেহাই= তিন ভাগের এক)উত্তর দেউলের উচ্চতা x গজ হলে শর্তমতে,
=> 15x+10x+3x+360=3x (উভয় পক্ষকে 2,3,10 এর ল,সা,গু 30 দ্বারা ভাগ করে)
=> 2x=360
=> 180
:. দেউলের উচ্চতা ১৮০ গজ।
আসুন আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা চিন্তা করে অতীতের আমাদের টেকনোলজিতে সমৃদ্ধি গুলো তুলে ধরি। না হলে অনেক কিছুই হারিয়ে যাবে এজন্য আমরাই দায়ী থাকবো।
খনার বচন :: আসুন আগলে রাখি আমাদের সম্পদ :: পরবর্তি প্রজন্ম যেন আমাদের গর্বের অতীত জানতে পারে!!!
কে বলেছে আমরা গরিব? যে জাতির এত এত সম্পদ তারা যদি সাময়িক ভাবে গরিব হয়েও থাকে, শুভদিন আবার আসবেই, আসতে বাধ্য। আমরাই পারবো আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে। অনেকেই বলবেন আমাদে এত এত জনসংখ্যা, কি করবো? কি ভাবে চলবো? এই জনসংখ্যা যদি জনসম্পদ হয় তাহলে কি হবে?আপনাদের পুরাতন সুন্দরকে বরণ করে নেয়া, আগ্রহ ও গঠনমূলক টিউমেন্ট আমার ভিরু মনটাকে অনেক আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছে। ওডেস্কে আমরা বর্তমানে আউটসোর্সিং এ তিন নম্বর। খুব শিষ্র শীর্ষস্থানে আসবো। আমরা যদি আমাদের সম্পদগুলোকে না চিনি না বুঝি তাহলে সেটা হবে চরম নিরাশার কথা।
লালনের একটি গান মনে পড়লো । শুনুন -
“রাম কি রহিম সে কোনজন?
মাটি কি পবন,
জল কি হুতাশন।
শুধাইলে তার অন্বেষণ,
মূর্খ দেখে কেউ বলে না।।”
খনার জীবনী আমি ভালো জানি না তাই জীবনীটুকু সংগ্রহ করতে হয়েছে উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে।
খনা বা ক্ষণা কথিত আছে তার আসল নাম লীলাবতী জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী এক বিদুষী নারীর যিনি বচন রচনার জন্যেই বেশি সমাদৃত, মূলত খনার ভবিষ্যতবাণীগুলোই খনার বচন নামে বহুল পরিচিত। মনে করা হয় ৮০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তার আবির্ভাব হয়েছিল। কিংবদন্তি অনুসারে তিনি বাস করতেন পশ্চিমবঙ্গের চব্বিস পরগনা জেলার বারাসাতের দেউলিয়া গ্রামে। তার পিতার নাম ছিন অনাচার্য। অন্য একটি কিংবদন্তি অনুসারে তিনি ছিলেন সিংহলরাজের কন্যা। বিক্রমপুরের রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজ সভার প্রখ্যাত জোতির্বিদ বরাহপুত্র মিহিরকে খনার স্বামীরূপে পাওয়া যায়। কথিত আছে বরাহ তার পুত্রের জন্ম কোষ্ঠি গণনা করে পুত্রের আয়ূ এক বছর দেখতে পেয়ে শিশু পুত্র মিহিরকে একটি পাত্রে করে সমুদ্র জলে ভাসিয়ে দেন। পাত্রটি ভাসতে ভাসতে সিংহল দ্বীপে পৌছলে সিংহলরাজ শিশুটিকে লালন পালন করেন এবং পরে কন্যা খনার সাথে বিয়ে দেন। খনা এবং মিহির দু'জনেই জ্যোতিষশাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। মিহির একসময় বিক্রমাদিত্যের সভাসদ হন। একদিন পিতা বরাহ এবং পুত্র মিহির আকাশের তারা গণনায় সমস্যায় পরলে, খনা এ সমস্যার সমাধান দিয়ে রাজা বিক্রমাদিত্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গণনা করে খনার দেওয়া পূর্বাভাস রাজ্যের কৃষকরা উপকৃত হতো বলে রাজা বিক্রমাদিত্য খনাকে দশম রত্ন হিসেবে আখ্যা দেন। রাজসভায় প্রতিপত্তি হারানোর ভয়ে প্রতিহিংসায় বরাহের আদেশে মিহির খনার জিহ্বা কেটে দেন। এর কিছুকাল পরে খনার মৃত্যু হয়।
এই রচনা গুলো চার ভাগে বিভক্ত করা যায়।
যথা
- কৃষিকাজের প্রথা ও কুসংস্কার।
- কৃষিকাজ ফলিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান।
- আবহাওয়া জ্ঞান।
- শস্যের যত্ন সম্পর্কিত উপদেশ।
১.
শ্রাবণের পুরো ভাদ্রের বার।
এর মধ্যে যত পার।।
[ধান রোপনের
প্রকৃত সময় সারা শ্রাবণ ও বারোই ভাদ্র পর্যন্ত]
২.
ষোল চাষে মূলা।
তার অর্ধেক তূলা।।
তার অর্ধেক ধান।
বিনা চাষে পান।।
[মূলার
ক্ষেত্রে
ষোল বার, তুলার
ক্ষেত্রে আট বার, ধানের ক্ষেত্রে চার বার হাল চালনা করা কর্তব্য। পানের জমিতে হাল চালনার প্রয়োজন নাই।]
৩.
পূর্ণিমা আমায় যে ধরে
হাল।
তার দুঃখ সর্বকাল।।
তার বলদের হয় বাত।
নাহি থাকে ঘরে ভাত।।
খনা বলে আমার বাণী।
যে চষে তার, প্রমোদ গণি।।
[পূর্ণিমা
আমারস্যাতে
হাল চালনা করতে নেই। ওই
দুই দিন যে হাল চালনা
করে তাকে চিরদিন কষ্ট পেতে হয়। বাতে সেই কৃষকের বলদ কষ্ট পায় ও তার গৃহে অন্ন
সংস্থান হয় না।]
৪.
যে বার গুটিকাপাত সাগর
তীরেতে।
সর্বদা মঙ্গল হয় কহে
জ্যোতিযেতে।।
নানা শস্যে পূর্ণ এই
বসুন্ধরা হয়।
খনা কহে মিহিরকে নাহিক
সংশষ।।
[সমুদ্র
তীরে যে বৎসর গুটিকাপাত হয়, ধরণী সেই বৎসর শস্যপূর্ণা হয়।]
৫.
বুধ রাজা আর শুক্র
মন্ত্রী যদি হয়।
শস্য হবে ক্ষেতভরা নাহিক
সংশয়।।
[যে
বছর বুধ রাজা ও শুক্র মন্ত্রী হয় সে বছর
পৃথিবী শস্য পরিপূর্ণ হয়।]
৬.
মঙ্গলের ঊষা বুধে পা।
যথা ইচ্ছা তথা যা।।
[ মঙ্গলবারের
রাত্রি গত হইলে ঊষাকালে
বুধবারের আরম্ভে যাত্রা করিলে যাত্রা শুভ হয়ে থাকে।]
৭.
রবি গুরু মঙ্গলের ঊষা।
আর সব ফাসাফুসা
[রবি,
বৃহস্পতি
আর মঙ্গলবারের ঊষাকালে যাত্রা করতে
পারলে দিন ক্ষন দেখবার কোনো প্রয়োজন হয় না।]
৮.
যদি বর্ষে আঘনে।
রাজা যান মাগনে।।
যদি বর্ষে পৌঁষে।
কড়ি হয় তুষে।।
যদি বর্ষে মাঘের শেষ।
ধন্য রাজার পুণ্যদেশ।।
যদি বর্ষে ফাল্গুনে।
চিনা কাউন দ্বিগুণে।।
[অগ্রহায়ণ
মাসে
যদি ভাল বর্ষণ হয়, তা হলে শষ্যকীটে ধান কেটে ফেলে। উত্তমরূপ শস্য না পাওয়ার দরুন প্রজাগণ রাজস্ব দিতে অক্ষম হয়, সে কারণে রাজাকেও বিপদগ্রস্ত হতে হয়। পৌষ মাসে বৃষ্টি হলে হৈমান্তিক ধান্য ঝরে পড়ে
ধান মহার্ঘ্য হয়ে যায়, আর তুষেও অর্থ উপার্জন হয়। আর যদি মাঘের শেষে বৃষ্টি হয় হেমন্তের ধান ও আশু ধানের কৃষি ভালোভাবে হয়ে থাকে। চিনা ও কাউন
ধান ফাল্গুন মাসে বৃষ্টি হলে দ্বিগুণ হয়ে থাকে]আজ খনার বচন নিয়ে গবেষনা হচ্ছে এত আগে তিনি এত বিজ্ঞানীক কথাবর্তা বলেছেন কি করে। হয়তো আমাদের মাঝেও এমন কেউ থাকা অসম্ভব নয় যাকে নিয় হয়তো আরও ৫০০ বছর পরে গবেষণার পর গবেষণা হবে।